বিদ্রোহী কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের একটি বিখ্যাত কবিতা। কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বিজলী পত্রিকায়। কবিতাটি তখন মাসিক প্রবাসী (মাঘ 1328), মাসিক সাধনা (1329 বৈশাখ) এবং ধূমকেতু (22 আগস্ট 1922) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। আজও, “চির উন্নত শির” কবিতাটি তার শক্তিশালী বিদ্রোহী চেতনা এবং অসাধারণ বাক্যাংশ ও ছন্দের জন্য বাঙালি মনসায় রয়ে গেছে।
বিদ্রোহী কবিতা কাজী নজরুল ইসলাম
বল বীর-
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি,
নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
বল বীর –
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!
মম ললাটে রুদ্র-ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর –
আমি চির-উন্নত শির!
আমি চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস,
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর!
আমি দুর্ব্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃংখল!
আমি মানি নাকো কোনো আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম,
ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!
আমি বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর!
বঙ্গবন্ধুর জীবনী – বাংলা রচনা | Biography of Bangabandhu – Bangla Essay
‘বিদ্রোহী‘ কবিতা মূলত আত্মজাগরণের কবিতা। মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। ‘বিদ্রোহী‘ কবিতার স্তবকে এমন দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের জয়জয়কার স্পষ্ট। আত্মমুক্তির মাধ্যমে জগৎ ও জীবন স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করতে পারে। কবিতায় ‘আমি‘ শব্দটি 121 বার ব্যবহার করে কবি একটি শব্দ প্রতিধ্বনিত করতে চেয়েছেন যে মানুষের অসম ক্ষমতা রয়েছে। সাধনা ও সংগ্রামে পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে স্বপ্নের স্বাধীন দেশ গড়ে তোলা সম্ভব। সাম্য, সত্য, সততা, অসাম্প্রদায়িকতা ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় এ কবিতার অবদান প্রচুর।
বিদ্রোহী কবিতায় নজরুলের বিদ্রোহী চেতনা প্রকাশ পায়। নজরুল বিদ্রোহ করেছিলেন ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। এই কাব্য রচনার জন্য নজরুল ‘বিদ্রোহী কবি‘ উপাধি পান।
বিদ্রোহী কবিতার পটভূমি বাংলা
বিদ্রোহী কবিতার পটভূমি: 1914 সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগুনে পুড়ছে গোটা বিশ্ব। ভারতীয় উপমহাদেশ তখন ব্রিটিশ শাসন ও শোষণ দ্বারা ক্ষতবিক্ষত ছিল। কাজী নজরুল ইসলামের বয়স ছিল ১৯ বছর সাত মাস। তিনি তখন সেনাবাহিনীর একজন উজ্জ্বল সৈনিক।
কুচকাওয়াজ করে শত্রুকে ধ্বংস করার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে নিয়োজিত। প্রতিটি মানুষই একজন যোদ্ধা, অসম সাহস ও বীরত্বের অধিকারী এই ধারণাটি তখন তৈরি হয়েছিল। আত্মসচেতন কবির মধ্যে অদম্য সাহস ছড়িয়ে পড়ে। নিপীড়িত-নিপীড়িত, শোষিত-অবহেলিত বঞ্চিত মানুষের জন্য একটি বেদনামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল। যার কারণে সে নিজেই মানব সমাজের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে পড়ে। আত্মার এই অব্যক্ত অভিপ্রায়ই তাকে এতটা অসাধারণভাবে আন্দোলিত করেছিল। আর তখনই সৃষ্টি হয় ‘বিদ্রোহী‘ কবিতার মতো কালজয়ী কবিতা।
নজরুল অল্প বয়সেই বঙ্গভঙ্গ (1905) এবং বঙ্গভঙ্গ (1911) আন্দোলন দেখেছিলেন। অর্থাৎ, তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন (1899) এবং তার শৈশব, কৈশোর এবং যৌবন একটি সংগ্রামী সময় কাটিয়েছেন। অন্য কথায়, ‘বিদ্রোহী‘ কবিতা লেখার সময়টা ছিল সারা বিশ্বের জন্য এক উত্তাল সময়। তা ছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীনতার জন্য ঘরে ঘরে আন্দোলন হয়েছে। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য ধর্ম নির্বিশেষে সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত।
পরাধীন দেশের সময়ের প্রয়োজনে এমন এক মুহূর্তে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন তার অমর কবিতা খানি; সেই কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিদ্রোহের নতুন ভাষা পেল। যুদ্ধ জয়ের নেশায় পাগল হয়ে ওঠে আবাল বৃদ্ধবনিতা। যে জাতির আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল এবং মুখোমুখি কথা বলার সাহস ছিল না, যে জাতি 1757 সালের 23শে জুন পলাশীর আম্রকাননে বিনা প্রতিরোধে স্বাধীনতা হারায়, সেই জাতি ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি পড়ে প্রবল আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। কবির কণ্ঠের বলিষ্ঠ উচ্চারণে ভারতবাসী একসঙ্গে গেয়ে উঠল- ‘আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমারে খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।‘