পার্বত্য শান্তিচুক্তি (পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান ও শান্তিচুক্তি) – বাংলা রচনা

পার্বত্য শান্তিচুক্তি রচনা

বাংলাদেশের সাংবিধানিক আইন ও বিধি মোতাবেক সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে কয়েক দফা সংলাপের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যা দেশের একটি ঐতিহাসিক চুক্তি। আর আজ আমি এটি নিয়েই রচনা আপনাদের সাথে উপস্থাপন করলাম।

পার্বত্য শান্তিচুক্তি

ভূমিকা: 

কোনাে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বাধীনতা তখনই অর্থবহ হয়ে ওঠে যখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা একযােগে কাজ করে। দেশের অগ্রগতির পথে বাধা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান সমস্যাগুলোর মধ্যে পার্বত্য এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ জটিল সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল। উপজাতি অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চল বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ।

এ অঞ্চলের সমস্যা দীর্ঘদিনের। আমাদের স্বাধীনতা লাভের সূচনালগ্ন থেকেই পার্বত্য সমস্যার সূত্রপাত হয়েছিল। তবে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকে এ সমস্যার সমাধানে দেশের প্রতিটি সরকারপ্রধানই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে বিবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তথাকথিত শান্তিবাহিনী সরকারের সদিচ্ছা পূরণে কোনো সমর্থন দেয় নি। যাক আশার কথা যে, আওয়ামী লীগ সরকার এ সমস্যার সমাধানের জন্যে ১৯৯৭ সালের ৩ ডিসেম্বর ‘শান্তিচুক্তি’ নামক এক চুক্তি সম্পাদন করেছেন।

পার্বত্য শান্তিচুক্তির পটভূমি: 

বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা- রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির মােট আয়তন দেশের এক দশমাংশ এবং লােকসংখ্যা প্রায় বার লক্ষেরও বেশি। তন্মধ্যে অর্ধেক বাঙালি এবং বাকি অংশ বিভিন্ন উপজাতি। উপজাতীয়দের জীবন ও সংস্কৃতিতে যে ভিন্নতা রয়েছে, তা টিকিয়ে রাখার জন্যে প্রায় দুই যুগের বেশি ধরে উপজাতীয়রা বিভিন্ন দাবিদাওয়া ও আন্দোলন চালিয়ে আসছিল।

মানবেন্দ্র লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য অঞ্চলের জনগণ তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গঠন করে ‘জনসংহতি সমিতি’। মানবেন্দ্র লারমার মৃত্যুর পর পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন তাঁর ছেলে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে লারমার নেতৃত্বে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’ নামে পাহাড়ি জনগণের একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে এর সঙ্গে যােগ হয় ‘শান্তি বাহিনী’ নামে একটি সামরিক শাখা। ১৯৭৭ সালে তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি সাঁজোয়া বহরের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়।

আরও পড়ুনঃ  প্রবন্ধ: বিজ্ঞান ও কুসংস্কার রচনা | Biggan o Kusanskar Rachana

এ সন্ত্রাস দমনের জন্যে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য অঞ্চলে বি.ডি.আর. ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করে এবং রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে কয়েকবার, বিএনপির আমলে ১৩বার দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চলে। কিন্তু কোনো চেষ্টাই সফল হয় নি।

চুক্তি সম্পাদন: 

আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর পার্বত্য সমস্যা নিয়ে নতুনভাধে শুরু হয় আলােচনা। শেষ পর্যন্ত এর সাফল্য হিসেবে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের লবিতে এ চুক্তি সম্পাদিত হয়। এ শান্তিচুক্তিতে সরকার পক্ষে স্বাক্ষর করেন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য জনসংহতি সমিতির পক্ষে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা।

শান্তিচুক্তির উল্লেখযােগ্য দিকসমূহ বা চুক্তির শর্তসমূহ:  

দীর্ঘদিনের অশান্ত পার্বত্য-অঞ্চলকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্যে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। এ নীতিমালার প্রধান দিকগুলো হলো

১. পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং স্বাক্ষরের পর থেকেই চুক্তি বলবৎ হবে।
২. বি.ডি.আর. ও স্থায়ী সেনানিবাস ব্যতীত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হবে।
৩. পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি, আধা সরকারি, পরিষদীয় ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরের নিয়োগে
উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
৪. পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হবে, একজন উপজাতীয় এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হবেন এবং পার্বত্য জেলা স্থানীয় পরিষদের নাম হবে ‘পার্বত্য জেলা পরিষদ’।
৫. প্রতি জেলা পরিষদের তিনটি মহিলা আসনের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ অ-উপজাতীয়দের জন্যে সংরক্ষিত থাকবে।
৬. জেলা পরিষদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া সরকার কোনো জমি, পাহাড়, বনাঞ্চল অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর করবে না। কাপ্তাই হ্রদের জলে ভাসা জমি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জমির মূল মালিকদের বন্দোবস্ত দেয়া হবে।
৭. তিন জেলা সমন্বয়ে ২২ সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হবে। এর মেয়াদকাল হবে পাঁচ বছর।
৮. পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন। তাঁর পদমর্যাদা হবে একজন প্রতিমন্ত্রীর সমকক্ষ ও তিনি হবেন একজন উপজাতীয়।
৯. আঞ্চলিক পরিষদ তিন জেলা পরিষদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সমন্বয় সাধন এবং তত্ত্বাবধান করবে। উপজাতীয় আইন ও সামাজিক বিচার আঞ্চলিক পরিষদের আওতাভুক্ত থাকবে এবং এটি ভারী শিল্পের লাইসেন্স প্রদান করবে।
১০. জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হবেন উপসচিবের সমতুল্য এবং এ পদে উপজাতীয় কর্মকর্তাদের
অগ্রাধিকার দেয়া হবে। জেলা পরিষদ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ করবে।
১১. পরিষদ পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর ও অধস্তন স্তরের সকল সদস্যকে নিয়ােগ করবে এবং উপজাতীয়রা অগ্রাধিকার পাবে।
১২. পরিষদের পূর্ব-অনুমােদন ছাড়া বন্দোবস্তযােগ্য খাসজমিসহ কোনো জায়গা-জমি ইজারা প্রদানসহ, বন্দোবস্ত, ক্রয়-বিক্রয় ও হস্তান্তর করা যাবে না। তবে সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ এলাকা , রাষ্ট্রীয় শিল্প-কারখানা ও সরকারের নামে রেকর্ডকৃত ভূমির ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য হবে না।
১৩. পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে চাইলে সরকার পরিষদের সঙ্গে আলাপ করবে।
১৪. শরণার্থী প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। তাদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা হবে এবং শরনার্থীদের ঋণ ও সুদ মওকুফ করা হবে।
১৫. সরকারি চাকরি ও উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা বহাল থাকবে।

আরও পড়ুনঃ  বাংলা নববর্ষ রচনা 15 পয়েন্ট

উপরিউক্ত নীতিমালার ভিত্তিতে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি
ও জনসংহতি সমিতির দুই প্রধান এই শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।

শান্তিচুক্তির প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ (ফলাফল): 

শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ি এলাকায় হানাহানি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়িতে সন্তু লারমা-দলের ৭৩৯ জন সদস্য অস্ত্র সমর্পণ করেন এবং অবশিষ্টরা পরবর্তীকালে অস্ত্র জমা দেন। প্রায় ৬৪০০০ শরণার্থী দেশে ফিরে আসে। আশা করা যায় এই চুক্তি বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।

পক্ষান্তরে, বিভিন্ন মহলে এ শান্তিচুক্তির ব্যাপারে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও লক্ষ করা গেছে। কোনো কোনো মহল বা বিশ্বের কোনাে কোনাে দেশের কাছে এ চুক্তি ‘স্মরণকালের সেরাচুক্তি’ হিসেবে অভিনন্দিত হলেও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তাকে ‘কালাে চুক্তি’ বলে আখ্যায়িত করেছে। শান্তিচুক্তির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সর্বদলীয় সমঝোতার ওপর। যদি দলমত নির্বিশেষে এ চুক্তির সঠিক এবং সফল বাস্তবায়ন হয় তবেই শান্তির নিশ্চয়তা বিধান হতে পারে।

আরও পড়ুনঃ  ছোটদের কম্পিউটার রচনা খুবই সহজ

উপসংহার:

বাংলাদেশের জনগণ শান্তিকামী। তারা শান্তিতে বসবাস করতে চায়। এবং একারণেই শান্তিচুক্তির বিরােধিতা করা কোনো ক্রমেই কাম্য হতে পারে না! শান্তিুচুক্তির ফলে দেশের সকল শ্রেণির নাগরিকের মধ্যে সৌহার্দ্য গড়ে উঠবে – একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে এটাই সকলের কাম্য হওয়া উচিত।

About the Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may also like these

Share via
Copy link